,

ভাতা পান ‘নকল মুক্তিযোদ্ধা’, দ্বারে দ্বারে আসলের সন্তানরা

জেলা প্রতিনিধি, গাইবান্ধা: ১৯৭১ সালের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণী মিয়া। যুদ্ধের সময় ভারতের ত্রিপুরহাট সেন্ট্রাল ইয়ুথ ক্যাম্পে প্যারামেডিক্যাল কোর্স সম্পন্ন করে ৬ নম্বর সেক্টরের রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার এই বীর সন্তান।

অভিযোগ উঠেছে, জালিয়াতি করে আব্দুল গণীর নামে গেজেটভুক্ত হয়ে তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন অন্য এক ব্যক্তি ও তার পরিবার।

এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে যুদ্ধকালীন নথি-প্রমাণসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেয়া হলেও এখনও প্রতিকার মেলেনি। গণী মিয়ার মৃত্যুর পর তার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি আর ভাতাসহ সুযোগ-সুবিধা পেতে বর্তমানে লড়ে যাচ্ছেন স্বজনরা।

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের সীচা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা গণী মিয়া (লাল মুক্তিবার্তা নং ০৩১৭০৩০১৩৭) মারা যান ১৯৯৮ সালের ৫ মে।

স্বজন ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, আব্দুল গণী মিয়ার মৃত্যুর পর তার নাম গেজেটভুক্ত করার আশ্বাস দিয়ে সব কাগজপত্র নিজের কাছে নিয়েছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং সেই সময়ের উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য দেওয়ান হামিদ। পরে তিনি আব্দুল গণীর কাগজপত্র দিয়ে আব্দুল বাকি নামে অন্য একজনকে গেজেটভুক্ত করতে সহায়তা করেন।

স্থানীয়রা জানান, মুক্তিযোদ্ধা বনে যাওয়া আব্দুল বাকির বাবার নাম মেহার উদ্দিন। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণীর বাবার নাম হেলাল উদ্দিন।

শুধু তাই নয়, আব্দুল বাকি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এমন তথ্যও জানা নেই স্থানীয়দের। ২০২১ সালে আব্দুল গণী সেজে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা আব্দুল বাকিও মারা যান। তার সন্তানরা এখন বাবার সুবিধা ভোগ করছেন।

এদিকে জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর অনেকের দ্বারে-দ্বারে ঘুরেও প্রতিকার পাচ্ছেন না আসল গণীর সন্তানরা। এ অবস্থায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তের দাবি জানিয়ে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেন আব্দুল গণীর ছেলে মঞ্জু মিয়া।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, হেলাল উদ্দিনের ছেলে আব্দুল গণীই ছিলেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। অথচ তার বদলে জালিয়াতি করে গেজেটভুক্ত হওয়াসহ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন মেহার উদ্দিনের ছেলে আব্দুল বাকি। জালিয়াতির এই ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান হামিদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা মুনছুর আলী বলেন, ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণীর সঙ্গে ট্রেনিংয়ের সময় আমার দেখা হয়েছিল। আব্দুল বাকিকে আমি কখনই দেখিনি। তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন।’

আরেক মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক বলেন, ‘হেলালের ছেলে গণীসহ আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। কাবলেরপাড়া থেকে গেন মানকের চর; তারপর তাবুরহাট- সেখান থেকে আমরা গেলাম হাট ট্রেনিংয়ে। একসাথে ট্রেনিং করলেও উনি ছিলেন ডাক্তারি লাইনে, আর আমরা সম্মুখযুদ্ধে।’

তিনি আরও বলেন, ‘৬ নম্বর সেক্টরে একসঙ্গে ছিলাম আমরা। আমার পায়ে গুলি লেগেছিল। তখন আমার চিকিৎসাও করে আব্দুল গণী মিয়া।’

তবে ওই গণীকে (আব্দুল বাকি) আমি যুদ্ধ বা ট্রেনিং কোথাও দেখিনি। হুট করে ইদানীং শুনছি, তিনিও নাকি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান।’

জালিয়াতির এই ঘটনায় জড়িত বীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান হামিদসহ দোষীদের শাস্তি দাবি করে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন বলেন, ‘আসল গণী মারা গেলে; দেওয়ান হামিদ তার ভায়রা ভাই বাকি গণীকে মুক্তিযোদ্ধা বানায়। সে সময় দেওয়ান হামিদ যাচাই-বাছাই কমিটিতে ছিলেন।’

আসল আর নকল ‘গণী’ কে- তা তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের পর জানা যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এই দুই ব্যক্তিকে নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দাবি করে আব্দুল গণী মিয়ার ছেলে মঞ্জু মিয়া বলেন, ‘আমার বাবা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দীর্ঘ ১৬ থেকে ১৭ বছর ধরে বাবার নামটা ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন অন্যজন। আর এই জালিয়াতি করেছেন দেওয়ান হামিদ।’

মঞ্জু আরও বলেন, ‘আমি বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। এটা কাউকে বোঝাতে পারি না; বলতে পারি না। এ জন্য মন কাঁদে। তাই আমি আমার বাবার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চাই।’

এদিকে আব্দুল গণী বনে যাওয়া আব্দুল বাকির বাড়িতে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি তার পরিবার। এমনকি তার মুক্তিযুদ্ধের কোনো গল্পও জানা নেই কারও।

আব্দুল বাকির বাড়িতে গিয়ে দেখা হয় তার ছেলে লাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি তার বাবার মুক্তিযুদ্ধের কোনো গল্প বলতে না পারলেও, বাবা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নন বলে দাবি করেন।

তিনি বলেন, ‘আমার বাবাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। আমরা আরেক জনেরটা নেব কেন? আমার বাবার নাম তো বাকি না। ওটা মানুষে ডাকে; ডাকনাম।’

আপনার বাবা কোথায় ট্রেনিং করেছেন, কত নম্বর সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওগুলো তো শুনেছিলাম একসময়, এখন মনে নেই। অনেক গল্প শুনছি তার কাছে- বড় বড় পিস্তল নিয়ে বেড়াইছেন আব্বা। যুদ্ধ করেছেন।’

আর এই বাকি মিয়ার নাতি নাজমুল মিয়া দাদার যুদ্ধের ইতিহাস বলতে গিয়ে বলেন, ‘এগুলো অনেক শুনছি দাদার কাছে। দাদা ট্রেনিং করছে কুড়িগ্রাম জেলাতে।’

যদিও নথিপত্র অনুযায়ী ৬ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং হয়েছে ভারতে।

এদিকে যোগসাজশ আর জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান হামিদ বলেন, ‘আল্লাকে হাজির নাজির রেখে বলতে পারব- আমি এই ধরনের কোনো কাজে কাউকে সহযোগিতা করিনি। এদের কারও পক্ষে বা বিপক্ষে আমি বক্তব্য দিতে রাজি নই।’

এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল-মারুফ বলেন, ‘মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল গণী মিয়ার ছেলে অভিযোগ করেছেন মন্ত্রণালয়ে। পরে মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে যাচাইসহ বিস্তারিত তথ্য চায়।’

এ অবস্থায় দুই পক্ষকে ডেকে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সিদ্ধান্তে তাদের কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলেও জানান ইউএনও।

তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি আমার কাছে স্পর্শকাতর মনে হয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে।’

এই বিভাগের আরও খবর